বাকৃবিতে শব্দহীন জীবন থেকে শব্দময় জগতে ফিরে আসার গল্প

বাকৃবি বিশেষ সংবাদদাতা:

ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, তা একজন মানুষের অস্তিত্ব, অনুভূতির রূপকার। শব্দে প্রকাশ পায় আমাদের আনন্দ, কষ্ট, ভালোবাসা ও ব্যথা। কিন্তু যদি কারও মুখ নিঃশব্দ হয়ে পড়ে? তখন অনুভূতিগুলো আটকে যায় হৃদয়ের গহীনে, ভালোবাসা বোঝাতে হয় চোখের জল দিয়ে, আর কষ্ট বলতে হয় নিঃশব্দ স্পর্শে। মুখের ভাষা না থাকা মানে চারপাশে রঙ থাকলেও হৃদয়ে থাকে অন্ধকার। এই ভাষাহীন মানুষগুলো প্রতিনিয়ত লড়াই করে নিজেদের প্রকাশ করার, বোঝানোর, অনুভূতির স্বীকৃতি পাওয়ার। তাদের নীরবতা যেন এক অনুচ্চারিত কবিতা—যার প্রতিটি পঙক্তি অনুভবে লেখা, শব্দে নয়। তাই ভাষা শুধু কথার বাহন নয়, তা জীবনের প্রাণবন্ত সেতু—যা হারিয়ে গেলে মন হয় বন্দী আর আত্মা হয় নিঃসঙ্গ।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) সিআরপি ময়মনসিংহ সেন্টারে স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্ট হিসেবে কর্মরত আছেন সাবরিনা হোসেন তৃষা। তার নিবিড় সেবায় ফিরে পেয়েছেন হারানো কণ্ঠস্বর ৩৫ বছরের সুমি। স্পিচ থেরাপির মাধ্যমে সুমির জীবনে আলো ফিরিয়ে এনেছেন তিনি।

সুমির জীবন ছিল একসময় স্বাভাবিক, হাসিখুশি ও প্রাণবন্ত। কিন্তু এক ভয়াবহ রাতে বাড়িতে সন্ত্রাসীদের হামলায় মাথায় মারাত্মক আঘাত পান তিনি। সেই আঘাত কেড়ে নেয় তার বাকশক্তি, গিলতে পারার ক্ষমতা এবং অনুভূতি প্রকাশের সামর্থ্য। ডাক্তারদের ভাষায়, সুমির অবস্থা ছিল গ্লোবাল অ্যাফেসিয়া, ওরো-ফ্যারিঞ্জয়াল ডিসফ্যাজিয়া, ও ডিসলেক্সিয়া।

সুমি যখন কিছু খেতে চাইতেন, শ্বাসরোধ, বমি এবং গলায় আটকে যাওয়া নিত্যকার ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। ডাক্তাররা জানিয়ে দেন—তিনি আর কখনও কথা বলতে পারবেন না।

তবুও আশার আলো নিয়ে এগিয়ে আসেন স্পিচ থেরাপিস্ট সাবরিনা হোসেন তৃষা। মাত্র ১২টি সেশন ও তিন মাসের থেরাপির মাধ্যমেই সুমির জীবনে ঘটে যায় এক বিস্ময়কর রূপান্তর। ছোট ছোট শব্দ দিয়ে শুরু করে একসময় তিনি বাক্য গঠন করতে শেখেন। ফিরে পান নিজের হারানো ভাষা।

সাবরিনা বলেন,”আমি এই পেশাটি বেছে নিয়েছি কারণ এটি নতুন এবং সমাজে একটি বাস্তব পরিবর্তন আনে। কথা বলা, গিলতে পারা বা কণ্ঠস্বরের সমস্যা—এসব মানুষের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। সঠিক সময়ে থেরাপি শুরু করলে দ্রুত উন্নতি হয়।”

তিনি আরও বলেন,”বাংলাদেশে এই পেশা এখনও বেশ অজানা। অথচ এর প্রয়োজনীয়তা বিশাল। স্পিচ থেরাপি মানে শুধু কথা বলা শেখানো নয়—এটি জীবনে ফিরে আসার এক নতুন সুযোগ।”

সুমির কণ্ঠস্বর ফিরে পাওয়া কেবল একটি ব্যক্তিগত পুনর্জন্মের কাহিনি নয়, বরং এটি হাজারো নিঃশব্দ মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার বাতিঘর। তার গল্প প্রমাণ করে- সঠিক চিকিৎসা, যত্ন, এবং বিশ্বাস থাকলে শব্দহীন জীবনেও ফিরতে পারে ভাষা, হাসি এবং অনুভূতির উষ্ণতা।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *