কুড়িগ্রামে সূর্যমুখী চাষ: এক নারীর সাহসী উদ্যোগে সাফল্যের গল্প

কৃষিবিদ মোঃ মঞ্জুুরুল হক

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নদীভাঙনের কারণে উত্তরবঙ্গের অন্যতম প্রান্তিক জেলা কুড়িগ্রামে কৃষকজীবন বরাবরই কঠিন। তবে প্রতিকূলতার মাঝেও নতুন সম্ভাবনার সন্ধানে কেউ কেউ দেখাচ্ছেন পথ—তেমনই একজন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার চেরেঙ্গা গ্রামের গৃহিণী ও কৃষক আশরাফুন নাহার। সূর্যমুখী চাষ করে তিনি যেমন আত্মনির্ভর হয়েছেন, তেমনি স্থানীয় কৃষকদের জন্য তৈরি করেছেন এক নতুন অনুপ্রেরণার গল্প।

পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে আশরাফুন নাহার একসময় ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে স্বামীর জন্য সিএনজি কিনে দেন। স্বামী সিএনজি চালানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়লে, জমির দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন তিনি। তবে ধান-আলুর গতানুগতিক চাষে খুব একটা লাভ না হওয়ায় আশরাফুন হয়ে পড়েন হতাশ।

২০২৪ সালের মার্চ মাসে তার জীবনে আসে নতুন এক মোড়। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)ইফাদ অর্থায়িত, এসকেএস ফাউন্ডেশন বাস্তবায়িত আরএমটিপি-সীডস ভ্যালু চেইন উপ-প্রকল্পে যুক্ত হন তিনি। সেখানে কৃষি প্রশিক্ষণ ও কর্মশালায় অংশ নিয়ে জানতে পারেন সূর্যমুখী চাষের সম্ভাবনার কথা।
তিনি বলেন, “প্রকল্পের প্রশিক্ষণে গিয়ে বুঝি, এই ফসল আমাদের এলাকার জন্য উপযোগী—আর আমি ঠিক করেই ফেলি, আমি সূর্যমুখী চাষ করব।”

তার আগ্রহে সাড়া দিয়ে প্রকল্পের পক্ষ থেকে তাঁকে সরবরাহ করা হয় “বারি সূর্যমুখী-৩” জাতের প্রজনন বীজ ও অনুদান। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে ১৫ শতক জমিতে শুরু করেন সূর্যমুখী চাষ। প্রশিক্ষণের নির্দেশনা মেনে নিজ হাতে জমি প্রস্তুত থেকে শুরু করে বীজ বপন, সার প্রয়োগ, সেচ, আগাছা দমনসহ প্রতিটি ধাপে তিনি নিজেই কাজ করেন। সঠিক পরিচর্যায় তার ক্ষেত পরিণত হয় এক নয়নাভিরাম সোনালি ফুলের সমারোহে।

আশরাফুন নাহার বলেন, “যখন গাছে ফুল ফুটল, তখন চারপাশের মানুষ দেখতে আসত। তবে আমার কাছে সবচেয়ে বড় আনন্দ হলো—এই চাষ আমাকে আয় দিয়েছে।”
চাষ শেষে তিনি পান প্রায় ৪০ কেজি সূর্যমুখী বীজ, যার বাজারমূল্য প্রায় ৪,০০০ টাকা। এছাড়া প্রায় ১৫ কেজি নিম্নমানের বীজ তিনি তেল হিসেবে ব্যবহার করেন।

প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী উৎপাদিত মানসম্পন্ন বীজের অর্ধেক তিনি প্রকল্প অফিসে জমা দেন এবং বাকি অর্ধেক নিজে সংরক্ষণ করেন। ভবিষ্যতে এই বীজ তিনি আশেপাশের কৃষকদের কাছে বিক্রি করে আরও আয় করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।

আশরাফুন নাহার এখন শুধু একজন সফল কৃষকই নন, বরং গ্রামের অন্যান্য কৃষকদের সূর্যমুখী চাষে আগ্রহী করে তুলছেন। তার অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, কুড়িগ্রামের জলবায়ু ও মাটির ধরন সূর্যমুখীর জন্য আদর্শ। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতায় এই চাষ লাভজনক ও টেকসই বিকল্প হয়ে উঠতে পারে।

কৃষি ক্ষেত্রে নারীর নেতৃত্বের উজ্জ্বল উদাহরণ আশরাফুন নাহারের এই সাফল্য প্রমাণ করে যে, পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ, পরিশ্রম এবং সঠিক সহায়তা থাকলে নারী কৃষকরাও কৃষি খাতে বিপ্লব ঘটাতে পারেন। সূর্যমুখী চাষ শুধু আর্থিক মুক্তির পথ নয়, এটি হয়ে উঠেছে নারীর ক্ষমতায়নের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

সূর্যমুখী এখন শুধু একটি ফসল নয়, বরং কুড়িগ্রামের মানুষের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার সূর্য। এগিয়ে চলুক কৃষকের সাফল্যের এই গল্প—উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *