আক্তার হোসাইন:
আগামী জুনের প্রথম সপ্তাহে জাতির সামনে তুলে ধরা হবে আগামী (২০২৫-২০২৬) অর্থ বছরের জাতীয় বাজেট। জাতীয় সংসদ না থাকায় বাজেটটি পেশ করবেন অর্থ উপদেষ্টা সালাউদ্দিন আহমেদ। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ বাজেট ঘোষণা করা হবে। প্রচলিত বিধান অনুযায়ী রাজনৈতিক সরকারের অর্থমন্ত্রীরা সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেন। তবে জাতীয় সংসদ কার্যকর না থাকায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালাউদ্দিন আহমেদ বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মত টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের মাধ্যমে বাজেটটি উপস্থাপন করবেন। তিনি ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন বাজেটের আকার কেমন হতে পারে এবং আরোও ধারণা দিয়েছেন গত অর্থবছরের সমান বা তার চেয়ে ছোট আকারের বাজেট হতে যাচ্ছে এটি। কারণ হলো বিদেশি ঋণের সুদ পরিষদের চাপ, রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি এবং বিভিন্ন দাবি-দাবা মিটানোর প্রচেষ্টা ইত্যাদি।
গত ১২ মার্চ ২০২৫ তারিখে প্রথম আলো একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বাজেটে সিংহভাগ অর্থের যোগান দেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চলতি বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের মূল লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্য সেই লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫ শত কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই – জানুয়ারি) এনবিআর রাজস্ব আদায় করেছে প্রায় ১ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে সংস্থাটির রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি ৫১ হাজার কোটি টাকা। রিপোর্টটিতে অর্থ উপদেষ্টা সালাউদ্দিন আহমেদ এর বরাত দিয়ে আরো বলা হয়, নানা কারণে আগামী বাজেট ছোট হচ্ছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকারও ছোট হবে। নতুন করে বড় কোন প্রকল্প নেয়া হবে না। তবে যে সব বড় প্রকল্প আছে, সেগুলোতে অর্থায়ন চলমান থাকবে। এর পরের দিন ওই পত্রিকায় আরেকটি রিপোর্ট করা হয়, “সড়কটি যেন সোনা দিয়ে মোড়ানো ”হবে। সওজ এর সূত্র ধরে বলা হয়, প্রতি কিলোমিটার সড়কে ব্যয় হয়, ঢাকা-ভাঙ্গা (চার লেন) ২০১ কোটি টাকা, কক্সবাজার-মাতারবাড়ি (দুই লেন) ৪৭৬ কোটি টাকা।
রিপোর্টটিতে আরোও তুলে ধরা হয় বিভিন্ন দেশের প্রতিটি সড়কে কি পরিমাণ ব্যয় হয়। তাতে দেখা যায় আমাদের দেশের রাস্তা সত্যি সোনা দিয়ে মোড়ানো সম্ভব যদি সঠিক ও পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবহার হয়। দুর্নীতির চিত্র প্রতিটা ক্ষেত্রে এতটাই ভয়াবহ যে কারণে বাংলাদেশের উন্নয়ন অনেকাংশেই সম্ভব হয় না। যদি এই দুর্নীতিটাকে নির্মূল নয়, নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হয় তাহলেই দেশটি হবে সোনার বাংলাদেশ। অথচ চলতি বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হবে এবং ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদিত হয়েছিলো পূর্বেই। আগামী জাতীয় বাজেট ছোট হলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিও (এডিপি) অবশ্যই ছোট হবে। সামর্থ্য থাকলে সকল অভিভাবক তার সর্বোচ্চ দিয়ে সন্তানের জন্য সর্বোচ্চ বাজেট দিয়ে থাকেন। আমাদের দেশে এত কর্মক্ষম মানুষ থাকার পরও বিশাল ঘাটতি নিয়ে জাতীয় বাজেট পেশ করতে হয়। কারণ প্রতিটা ক্ষেত্রেই দুর্নীতি। একারণেই বিশ্বে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪ তম।
কাস্টমস ও এনবিআর রাজস্ব আদায়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। তাদের উপর ভর করেই প্রণীত হয় জাতীয় বাজেট। কিন্তু যদি তারাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয় তাহলে দেশের অর্থনীতির কি অবস্থা হবে? তাদেরই দুর্নীতির দু একটি চিত্র তুলে ধরা হলো: আমাদের ব্যাংক থেকে খুদেবার্তায় গ্রাহকদের জানানো হয় আপনার হিসেবের বিপরীতে আয়কর প্রাপ্তিস্বীকার পত্রটি ব্যাংকে জমা দিন। খুদেবার্তাটি পেয়ে মার্চের প্রথম সাপ্তাহে একজন গ্রাহক ব্যাংকে আসেন তা জমা দিতে। তিনি পেশায় একজন কলেজ শিক্ষক। তিনি বেশ প্রফুল্ল চিত্তে বললেন, এবার আয়কর আমি নিজেই অনলাইনে জমা দিয়েছি সাথে আমার স্ত্রীরটাও। প্রাপ্তিস্বীকার পত্রটি আপনার মেইলে দিচ্ছি, আপনি একটু প্রিন্ট করে নেন। আমি মেইল পাওয়ার পরে দেখলাম কোন কারণে তার আয়কর দাখিল হয়নি কিন্তু সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে এ চালানে টাকা পরিশোধিত হয়েছে এবং ৫ থেকে ৬ দিনে ৬২ হাজারের উপরে ডিউ বা অপরিশোধিত দেখাচ্ছে। আমি তাকে উপদেশ দিলাম আপনার আয়করটি যেহেতু কোন কারণে দাখিল হয়নি, আপনি সরাসরি আয়কর অফিসে গিয়ে বিষটি খুলে বলুন। উনি যথারীতি আয়কর অফিসে যান এবং খুলে বলেন। এ অবস্থায় তার কাছ থেকে সরাসরি আয়কর অফিস কর্মকর্তারা ৩০ হাজার টাকা উৎকোচ দাবি করে এবং ঘটনাটি ১০ হাজার টাকায় মীমাংসিত হয়। বিষয়টি হলো এই দশ হাজার টাকা ব্যক্তির পকেটে গিয়েছে সরকারের খাতে ১০ পয়সাও জমা হয়নি। কিন্তু যদি তাকে মওকুফ করে দেয়া যেত বা কোন মানি রিসিভের মাধ্যমে টাকাটি গ্রহণ করা যেত তাহলেও তার মধ্যে দেশ প্রেম জাগ্রত হত এবং সরকারেরও রাজস্ব বৃদ্ধি পেত।
অপর একজন গ্রহকের কাছে শোনা গল্প লেখছি, ব্যাপারটা এমন যে তার নতুন কোল্ডস্টোরেজের জন্য বিদেশ হতে যন্ত্রপাতি ঋণপত্রের মাধ্যমে দেশে আমদানি করেন। প্রতিটি আমদানির জন্য সরকারি রাজস্ব খাতে শুল্ক জমা দিতে হয়। কিছু পণ্যে বা যন্ত্রপাতিতে শুল্ক মওকুফ করে থাকেন বা নামমাত্র শুলকে আমদানির অনুমতি দিয়ে থাকে। আর এই সুযোগে ওই গ্রাহক নামমাত্র শুল্কের যন্ত্রপাতির বক্সে সকল যন্ত্রপাতি নিয়ে আসেন। কিন্তু কাস্টমস অফিসার বিষয়টি বুঝতে পেরে আটকে দেন এবং তাকে অসৎ প্রস্তাব দেন। জটিলতা তৈরি হলে বিভিন্ন মাধ্যম ধরে অসাধু উপায়ে ওই অফিসার কে ১৭ লক্ষ টাকা উৎকোচ দিয়ে বিষয়টি রফাদফা করেন। ওই গ্রাহক বলেন যে, সে যন্ত্রপাতিগুলোর জন্য ৫০ লক্ষ টাকা উৎকোচ দিতেও প্রস্তুত। কারণ প্রকৃতভাবে যন্ত্রপাতি আমদানি করতে প্রায় ২ কোটি টাকার অধিক শুল্ক দিতে হবে সরকারের রাজস্ব খাতে, সাথে জরিমানাও রয়েছে। উক্ত ঘটনা দুটিতে ব্যক্তি ও কর্মকর্তার কারণে সরকার তার রাজস্ব হারাচ্ছে এবং অসৎ ব্যক্তির জন্য সুযোগ তৈরি হচ্ছে। ফলে সরকারকে ঘাটতি নিয়ে জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করতে হচ্ছে। কিন্তু যদি জনগণ ও কর্মকর্তারা সৎ হয় তাহলে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। দুর্নীতি চিত্রটা পুরোপুরি বোঝানোর জন্য আরো একটি উদাহরণ দেওয়া হল।
অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খান রচিত আজব ও যবর-আজব অর্থনীতি বই হতে একটি গল্প উল্লেখ করা হলো। একবার একজন নিরীক্ষক একটি কারখানা নিরীক্ষার দায়িত্ব নেন। বাজারে গুজব ছিল যে প্রতিষ্ঠানটি থেকে বিপুল পরিমাণ চুরি হয়। নিরীক্ষক চুরি ধরার জন্য তৎপর হলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তিনি কোন অনিয়ম দেখতে পাননি। (অবশ্য সব চোর সতর্ক হয়ে গিয়েছিল)। শুধু বিকেলের দিকে একটি রহস্যজনক ঘটনা দেখতে পান। একটি ঠেলাগাড়ি, যার উপর একটি অস্বচ্ছ কাপড় দিয়ে কী যেন ঢাকা দেয়া আছে, তোরণের দিকে যাচ্ছে । নিরীক্ষক সঙ্গে সঙ্গে ঠেলাগাড়িটি তোরণের কাছে আটকে দেন। কিন্তু কাপড় তুলে কিছুই পাওয়া গেল না। বাধ্য হয়ে ঠেলাগাড়িতে ছেড়ে দেওয়া হল। পরদিন একই ধরনের একটি ঠেলাগাড়ি অস্বচ্ছ কাপড়ে থাকা অবস্থায় তোরণের কাছে এল। তাকে আটকিয়ে আবার তন্নতন্ন করে খোঁজা হল। কিছুই পাওয়া গেল না। একই ভাবে একই ঘটনা পরপর সাতদিন ঘটলো। অষ্টম দিন নিরীক্ষক কারখানার নিরীক্ষা শেষ করে তার অফিসে ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি আবার অসচ্ছ কাপড়ে থাকা একটি ঠেলাগাড়ি দেখতে পান। তিনি ঠেলাগাড়িটি আটকালেন ও গাড়োয়ান কে বললেন, আমি আপনার গাড়ি আর পরিদর্শন করবো না। আমি বুঝতে পারছি আপনি কাপড় দিয়ে ঢেকে কিছু সরাচ্ছেন। কিন্তু কি সরাচ্ছেন বুঝতে পারছি না। হলফ করে বলছি, আমি আপনার কোন ক্ষতি করব না। আপনার কাছে আমি চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো, যদি মেহেরবানী করে আপনি কি চুরি করছেন তা আমাকে জানান। গাড়োয়ান একটু হেসে বলল, আমি ঠেলাগাড়ি চুরি করি। নিরীক্ষক আদৌ সন্দেহ করেনি যে ঠেলাগাড়িও চুরি হয়।
আমাদের দেশের অবস্থাটা এমনই সকল ক্ষেত্রেই দুর্নীতি হচ্ছে কিন্ত কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তাই সরকারও ঘাটতি নিয়ে জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করছেন, সরকার চাইলেও ভোক্তা পন্যে কর অব্যাহতি দিতে পারছেনা।