সম্পূরক খাদ্যে ভাসমান খাঁচায় ভেটকি চাষে অভাবনীয় সাফল্য

বাকৃবি প্রতিনিধি:

বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের লোনা পানির মাছ হিসেবে কোরাল বা ভেটকি মাছ অতি পরিচিত ও জনপ্রিয়। তবে স্বাদ ও পুষ্টিগুণের পরও উপযুক্ত পোনা ও কৃত্রিম খাদ্যের অভাবে এর উৎপাদন ছিল সীমিত। এর ফলে মাছটি কিনতে হতো উচ্চমূল্যে। এবার মাছটিকে সহজলভ্য করা ও উৎপাদন বৃদ্ধির পথে যুগান্তকারী সাফল্য পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) গবেষকেরা।

দেশে প্রথমবারের মতো উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রে ভাসমান খাঁচায় কৃত্রিম সম্পূরক খাদ্য ব্যবহার করে এই ভেটকি চাষে অভাবনীয় সফলতা পেয়েছে গবেষক দল। শুধু চাষই নয়, খাঁচায় উৎপাদিত মাছের গুণগত মানও ছিল প্রচলিত চাষকৃত মাছের চেয়ে উঁচু মানের।

বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) দুপুর ১২টায় এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহজাহান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ফিশ ইকোফিজিওলজি ল্যাবরেটরিতে ওই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এবং মৎস্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে, সাসটেইনেবল কোস্টাল মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্টের (এসসিএমএফপি) আওতায় এই গবেষণা পরিচালিত হয় বলে জানান প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. মো. শাহজাহান। গবেষণায় সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী জাবেদ হাসান।

সংবাদ সম্মেলনে প্রধান গবেষক জানান, ‘এই গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল দেশে প্রথমবারের মতো সম্পূরক খাদ্য ব্যবহার করে ভাসমান খাঁচায় ভেটকি চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই করা। দেশের উপকূলীয় তিনটি অঞ্চলে (সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ, কক্সবাজারের মহেশখালী এবং ভোলার চর কুকরি-মুকরি) এই গবেষণার মাঠপর্যায়ের কাজ হয়। প্রত্যেক এলাকায় স্থানীয় মৎস্যজীবী সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করে খাঁচা তৈরি থেকে শুরু করে চাষের প্রতিটি ধাপে তাদের যুক্ত করা হয়।’

খাঁচায় কোরাল মাছের চাষ পদ্ধতি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষক জানান, ‘খাঁচা তৈরি হয়েছে ৬ দশমিক ৭ মিটার বৃত্তাকার আকারে, যার ধারণক্ষমতা ৬০ ঘনমিটার। প্রতি ঘনমিটারে ১৫টি করে পোনা মজুদ করা যায়। কৃত্রিম সম্পূরক খাদ্য ব্যবহার করে টু-টায়ার চাষ পদ্ধতি অর্থাৎ প্রথমে জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসে নার্সিং (প্রাক-পর্যায় চাষ) এবং পরে খাঁচায় স্থানান্তর করে বড় করার মাধ্যমে এই মাছ চাষ করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, কৃত্রিম খাদ্যে মাছের বৃদ্ধি বা পুষ্টিগুণে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি।’

সমসাময়িক অন্য একটি গবেষণায়, ভেটকি মাছ রাক্ষুসী প্রকৃতির হওয়ায় প্রথমে তাদের তেলাপিয়া মাছ কেটে (মাছের মুখের আকার অনুযায়ী) খাওয়ানো হয়। এরপর ধাপে ধাপে বাণিজ্যিক ফিড এর সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো হয় এবং শেষে গবেষণাগারে তৈরি করা উচ্চ ৩৭ শতাংশ প্রোটিনযুক্ত সম্পূরক খাদ্যে অভ্যস্ত করা হয়।

গবেষণার চূড়ান্ত ফলাফল ও লাভজনকতার বিষয়ে গবেষক বলেন, ‘এক বছর শেষে প্রতিটি খাঁচা থেকে গড়ে ৮০০ থেকে ৮৫০ কেজি মাছ উৎপাদিত হয়েছে। প্রতি ঘনমিটারে উৎপাদন হয়েছে ১৩ থেকে ১৭ কেজি । যেখানে পুকুর বা ঘেরে প্রচলিত পদ্ধতিতে গড়ে প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হয় ৬০০ থেকে ১৫০০ কেজি। খাঁচায় চাষকৃত মাছের গড় আমিষের পরিমাণ ১৯ গ্রাম, যেখানে সাধারণ কোরালে এই পরিমাণ ১৭ গ্রাম।’

গবেষণায় হিসাব ও মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, খাঁচায় এই মাছ চাষে প্রতি এক টাকা বিনিয়োগে প্রায় ১ দশমিক ৭০ টাকা আয় নিশ্চিত করা সম্ভব। তাছাড়া নদীর জায়গা ব্যবহারে কোনো জমি ভাড়া দিতে না হওয়ায় কৃষকদের খরচও কমে আসে। ৫ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত একটি খাঁচা ব্যবহারযোগ্য যেখানে প্রতিবারে প্রায় এক হাজার কেজি মাছ চাষ করা সম্ভব। বর্তমানে প্লাস্টিক দিয়ে খাঁচা তৈরি করা হলেও, প্রান্তিক চাষিরা চাইলে বাঁশ বা সাধারণ মাছ ধরার জাল দিয়েও কম খরচে এটি তৈরি করতে পারবেন।

ড. শাহজাহান আরও জানান, ‘এই পদ্ধতিতে রোগবালাইয়ের আশঙ্কা কম, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি কম এবং মাছের একে অপরকে খেয়ে ফেলার সম্ভাবনাও থাকে না। ০ থেকে ৩৫ পিপিটি (পার্টস পার মিলিয়ন) লবণাক্ত পানিতেও এই মাছ টিকে থাকতে পারে, যা একে উপকূলীয় চাষের জন্য উপযোগী করে তুলেছে।’

প্রান্তিক মাছ চাষীদের জীবনযাত্রার মানে এই গবেষণার প্রভাব নিয়ে প্রধান গবেষক বলেন, ‘খাঁচায় ভেটকি চাষ শুধু মাছ উৎপাদন বাড়াবে না, বরং উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র মৎস্যজীবীদের জন্য বিকল্প আয়ের সুযোগ তৈরি করবে। প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে মেরিকালচারের (সামুদ্রিক মাছচাষ) বিকাশের একটি টেকসই পথ দেখাবে এই প্রযুক্তি। গবেষণার সফলতা প্রমাণ করেছে যে, সামুদ্রিক মাছকে খাঁচায় এবং কৃত্রিম খাদ্যে অভ্যস্ত করিয়ে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা সম্ভব। এতে করে আমাদের মৎস্য উৎপাদন বহুগুণে বাড়বে এবং ব্লু ইকোনমিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ জোরদার হবে।’

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *