উত্তরাঞ্চলের ভুট্টা শিল্প: কৃষি নির্ভরতা থেকে শিল্পায়নের উত্তরণ


বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে ভুট্টা একটি সম্ভাবনাময় ফসল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষত উত্তরাঞ্চলের জেলা—রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও দিনাজপুরে বিগত এক দশকে ভুট্টা চাষে বিপ্লব ঘটেছে। উর্বর মাটি, অনুকূল জলবায়ু, কৃষকদের পরিশ্রম এবং প্রযুক্তির ব্যবহারে আজ এই অঞ্চল দেশের ভুট্টা উৎপাদনের প্রধান ভান্ডারে পরিণত হয়েছে। অথচ এই উৎপাদন-সাফল্য কৃষকের ভাগ্য বদলাতে পারছে না—এর পেছনে রয়েছে প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থার অনুপস্থিত

আজ সময় এসেছে বিষয়টিকে কেবল একটি কৃষিনির্ভর সমস্যা হিসেবে না দেখে, বরং তা জাতীয় উন্নয়নের অংশ হিসেবে বিবেচনার। ভুট্টা প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তুলতে পারলে তা হবে দেশের অর্থনৈতিক উত্তরণের এক নতুন ভিত্তি—যেখানে কৃষি ও শিল্পের সেতুবন্ধন তৈরি হবে।

ভুট্টা কেবল পশুখাদ্য নয়; এটি বিশ্বজুড়ে খাদ্য ও শিল্প কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কর্নফ্লেক্স, ভুট্টার তেল, কর্ন স্টার্চ, কর্ন সিরাপ, এথানল, এমনকি প্রসাধনী শিল্পেও এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। বিশ্ববাজারে ভুট্টাজাত পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। অথচ আমরা এখনও এদেশে ভুট্টাকে কাঁচা অবস্থায় বিক্রয়যোগ্য পণ্য হিসেবেই ধরে রেখেছি, যেখানে কৃষক মৌসুম শেষে দামপতনের শিকার হয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হন।

যদি উত্তরাঞ্চলে প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলা যায়, তবে ভুট্টা রূপান্তরিত হবে মূল্য সংযোজিত পণ্যে। এতে করে কৃষকের উৎপাদন হবে লাভজনক, বাজার হবে স্থিতিশীল এবং শিল্প সম্ভাবনা হবে বাস্তব।

প্রতি বছর দেখা যায়, চাষের মৌসুমে ভুট্টার দাম ভালো থাকে না। প্রক্রিয়াজাত না করার ফলে কৃষক বাধ্য হন স্থানীয় হাটে ন্যায্যমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে ভুট্টা বিক্রি করতে। সংরক্ষণের সুবিধা না থাকায় তারা কাঁচা ফসল হাতে রেখে অপেক্ষাও করতে পারেন না।

এ সুযোগে মাঠে নামে মধ্যস্বত্বভোগীরা—যারা কৃষকের দুরবস্থাকে পুঁজি করে লাভবান হন। অথচ একই ফসল পরে গুদামে সংরক্ষণ করে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয়। এটা শুধু কৃষকের নয়, গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থারই একটি ব্যর্থতা।

প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তুললে এই চিত্র বদলাবে। কারখানা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ভুট্টা কিনবে, বাজারে দামের ভারসাম্য আসবে, এবং কৃষকের শ্রমের মূল্য দিতে বাধ্য হবে বাজার।
উত্তরাঞ্চলে একটি ভুট্টা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা শুধু একটি কারখানা নয়, এটি হতে পারে একটি শিল্প চক্রের কেন্দ্র। কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এখানকার তরুণদের কর্মসংস্থান হবে। একইসাথে পরিবহন, সংরক্ষণ, বিপণন, প্যাকেজিং, যন্ত্র রক্ষণাবেক্ষণসহ অঙ্গ-সহযোগী খাতগুলোতেও নতুন উদ্যোগ ও কর্মসংস্থানের পথ খুলবে।

আজ যখন দেশের যুবসমাজ বেকারত্বে হতাশ, তখন এই ধরণের শিল্প স্থাপনা হতে পারে তাদের জন্য নতুন আশার আলো। এটি শহরমুখী চাপ কমাবে, গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করবে।

বিশ্ববাজারে ভুট্টা ও এর প্রক্রিয়াজাত পণ্যের চাহিদা বিপুল। কর্নফ্লেক্স, কর্ন অয়েল, স্টার্চ, বায়োফুয়েল এমনকি পোল্ট্রি ও গবাদিপশুর প্রিমিয়াম ফিড রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে। উত্তরাঞ্চলে গড়ে ওঠা ভুট্টা শিল্প এই খাতে দেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধিকে বহুগুণে বাড়াতে পারে।

আমরা যদি গার্মেন্টস নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই, তবে কৃষি-প্রক্রিয়াজাত শিল্প রপ্তানি আমাদের জন্য একটি বড় বিকল্প হয়ে উঠবে।

এই রূপান্তর সম্ভব হবে তখনই, যখন সরকার বিষয়টিকে ‘স্ট্র্যাটেজিক সেক্টর’ হিসেবে ঘোষণা দেবে। অর্থনৈতিক অঞ্চল বা শিল্পপার্কে ভুট্টা ভিত্তিক বিশেষ জোন তৈরি করে প্রণোদনা, ব্যাংক ঋণে সহজতা, কর অবকাশ ও ভর্তুকি দিয়ে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আগ্রহী করে তুলতে হবে।

একইসাথে কৃষকদের প্রশিক্ষণ, কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রসার এবং বাজার তথ্য সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। একটি সমন্বিত নীতিমালার আওতায় কাজ করলে এই শিল্প শুধু প্রতিষ্ঠিত নয়, টেকসইও হবে।

ভবিষ্যতের দিকে তাকালে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই-উত্তরাঞ্চলে ভুট্টা প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠা আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরও বেশি ভারসাম্যপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই করে তুলতে পারে। এটি কৃষিকে কেন্দ্র করে শিল্পায়নের মডেল হতে পারে, যা কৃষক, উদ্যোক্তা, ভোক্তা ও রাষ্ট্র—সবার জন্য উপকারী হবে।

সরকার, বেসরকারি খাত ও কৃষকদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার সময়। কারণ, অব্যবহৃত সম্ভাবনা যতদিন নীতিনির্ধারকদের টেবিলে পড়ে থাকবে, ততদিন কৃষকও তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হবেন।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *